জমা’আতের নামাযের অন্যান্য মাসায়েল
জমা’আতের নামাযের অন্যান্য মাসায়েল
জমা’আতের নামাযের অন্যান্য মাসায়েল
১৯।মাসআলাঃ যে স্থানে অন্য পুরুষ বা ইমামের মা, ভগ্নী বা স্ত্রী ইত্যাদি কোন মাহরাম স্ত্রীলোক না থাকে, সেখানে পুরুষের জন্য শুধু স্ত্রীলোকের ইমামত করা মকরূহ তাহরীমী।
২০।মাসআলাঃ এক ব্যক্তি ফজর, মাগরিব বা এশার নামায একা একা অনুচ্চ শব্দে পড়িতেছিল। (প্রথম বা দ্বিতীয় রাকা’আতে সূরা-ফাতেহার কিছু অংশ বা ফাতেহা শেষ করিযা সূরারও কিছু অংশ চুপে চুপে পড়িয়া ফেলিয়াছে।) এমন সময় অন্য একজন লোক আসিয়া এক্তেদা করিল। এমতাবস্থায় যদি প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তির ইমামত করার ইচ্ছা (নিয়্যত) করে, তবে তৎক্ষণাৎ যে পর্যন্ত পড়িয়াছে তাহার পর হইতে উচ্চস্বরে কেরাআত পড়িতে হইবে। কারণ ফজরের এবং মাগরিব ও এশার প্রথম দুই রাকা’আতে ইমামের জন্য কেরাআত উচ্চস্বরে পড়া ওয়াজিব (মুনফারেদের জন্য ইচ্ছাধীন)। কিন্তু যদি প্রথম ব্যক্তি দ্বিতীয় ব্যক্তির ইমামত করার ইচ্ছা না করে; বরং এই মনে করে যে, সে এক্তেদা করুক কিন্তু আমি তাহার ইমামত করিব না, আমি আমার নিজের নামায একাই পড়িতেছি, তবে জোরে কেরাআত পড়া ওয়াজিব হইবে না, এই শেষোক্ত ছুরতে মুক্তাদীর নামায হইয়া যাইবে। কারণ, এক্তেদা হইবার জন্য মুক্তাদীর নিয়্যত শর্ত, ইমামের নিয়্যত শর্ত নহে।
২১।মাসআলাঃ যেখানে লোক চলাচলের সম্ভাবনা আছে, যেমন ময়দান, উঠান বা অনুরূপ স্থানে নামায পড়িতে হইলে নামাযী ইমাম হউক বা মুনফারেদ হউক নিজের ডান বা বাম চক্ষু বরাবর সম্মুখে অন্ততঃ এক হাত লম্বা এক অঙ্গুলী পরিমাণ মোটা কোন একটি জিনিস পুঁতিয়া রাখা মোস্তাহাব। ইহাকে ‘ছুতরাহ’ বলে। যেখানে লোক চলাচলের সম্ভাবনা নাই, যেমন- মসজিদ, ঘর বা অনুরূপ স্থানে ছুতরার আবশ্যক নাই।
ছুতরার বাহির দিয়া চলাচলে কোন গোনাহ হয় না। ভিতর দিয়া চলাচল করিলে ভীষণ গোনাহ হইবে। (হাদীসে আছেঃ চল্লিশ দিন দাঁড়াইয়া থাকা বরং ভাল, তবু নামাযীর সম্মুখ দিয়া যাতায়াত করা উচিত নহে।) ইমামের ছুতরাহ মুছল্লীদের জন্য যথেষ্ট। (পুঁতিতে না পারিলে বা পুঁতিবার মত উপযুক্ত কিছু পাওয়া না গেলে অগত্যা চেয়ার, টুল, মোড়া যাহা পাওয়া যায় এবং যে ভাবে রাখা যায় রাখিয়া দিবে। মানুষ ব্যতীত অন্য কোন জীবজন্তুর যাতায়াতে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না।)
২২।মাসআলাঃ লাহেক ঐ মুক্তাদীকে বলে, জমা’আতে শামিল হওয়ার পর যে মুক্তাদীর কিছু রাকা’আত বা সম্পূর্ণ রাকা’আত ছুটিয়া যায়। কোন ওযরবশতঃ হউক, যেমন নামাযে ঘুমাইয়া গেল, ইত্যবসের কোন রাকা’আত ইত্যাদি ছুটিয়া গেল, কিংবা লোকের আধিক্যের কারণে রুকূ সজদা ইত্যাদি করিতে পারিল না, কিংবা ওযূ টুটিয়া যাওয়ায় ওযূ করিতে গেল ইত্যবসরে কিছু রাকা’আত ছুটিয়া গেল, (খওফের নামাযে প্রথম দল লাহেক। এরূপে যে মুকীম মুক্তাদী মুসাফির ইমামের এক্তেদা করে এবং মুসাফির কছর করে, তখন সেই মুকীম ঐ ইমামের নামায শেষ করার পর লাহেক) কিংবা বিনা ওযরে ছুটিয়া গেল, যেমন ইমামের আগে কোন রাকা’আতের রুকূ বা সজদা করিল এবং এই কারণে এই রাকা’আত ধর্তব্য হইল না, তবে ঐ রাকা’আতের হিসাবে সে লাহেক বলিয়া গণ্য হইবে। লাহেকের কর্তব্য, যেই রাকা’আতগুলি ছুটিয়া গিয়াছে, প্রথমে ঐগুলি আদায় করিবে। তৎপর যদি জমা’আত বাকী থাকে, তবে জমা’আতে শরীক হইবে। নতুবা অবশিষ্ট নামাযও নিজে নিজে পড়িয়া লইবে।
২৩।মাসআলাঃ লাহেকের যে পরিমাণ নামায ছুটিয়া যায়, তাহা সে মুক্তাদীর মতিই পড়িবে অর্থাৎ, ইমামের পিছনে যেরূপ মুক্তাদীর কেরাআত পড়িতে হয় না, বা মুক্তাদীর ছহো সজদাও দিতে হয় না, তদ্রূপ লাহেকও তাহার নামায একা একা পড়িবার সময় কেরাআত পড়িবে না এবং তাহার ভুল হইলে তদ্দরুন ছহো সজদাও করিবে না।
২৪।মাসআলাঃ ইমামের সঙ্গে শরীক হইবার পূর্বে যে মুক্তাদীর কিছু রাকা’আত ছুটিয়া গিয়াছে তাহাকে ‘মাসবুক’ বলে। মাসবুকের প্রথমে যে কয় রাকা’আত ছুটিয়া গিয়াছে ইমামের সালাম ফিরানোর পর তাহা উঠিয়া পড়িবে।
২৫।মাসআলাঃ মাসবুকের যে কয় রাকা’আত ছুটিয়া গিয়াছে মনফারেদের মত কেরাআত সহকারে আদায় করিতে হইবে। আর যদি ঐ সমস্ত রাকা’আতে ছহো হয়, তবে সজদায় সহো করিতে হইবে।
২৬।মাসআলাঃ মাসবুকের যে কয় রাকা’আত ছুটিয়া গিয়াছে, তাহা আদায় করিবার নিয়ম এইঃ প্রথমে কেরাআত বিশিষ্ট রাকা’আত, তারপর কেরাআত বিহীন রাকা’আত আর যে কয় রাকা’আত ইমামের সঙ্গে পড়িয়াছে সেই হিসাবে বৈঠক করিবে অর্থাৎ ঐ রাকা’আতের হিসাবে যাহা দ্বিতীয় রাকা’আত হইবে, উহাতে প্রথম বৈঠক করিবে। আর তিন রাকা’আতী নামাযে যাহা তৃতীয় রাকা’আত হইবে, উহাতে শেষ বৈঠক করিবে। যেমন, যোহরের নামাযের তিন রাকা’আত হইয়া যাওয়ার পর কোন লোক শরীক হইল এখন সে ইমামের সালাম ফেরানোর পর দাঁড়াইয়া যাইবে এবং যে কয় রাকা’আত ছুটিয়া গিয়াছে তাহা আদায় করিবার নিয়ম হইল- প্রথম রাকা’আতে সুবহানাকার পর সূরা-ফাতেহার সহিত কোন একটি সূরা মিলাইয়া রুকূ সজদা করিয়া প্রথম বৈঠক করিবে ও তাশাহহুদ পড়িবে। কেননা, পাওয়া রাকা’আত হিসাবে ইহা দ্বিতীয় রাকা’আত। অতঃপর দ্বিতীয় রাকা’আতেও সূরা-ফাতেহার সহিত সূরা মিলাইবে এবং ইহার পর বৈঠক করিবে না। কেননা পাওয়া রাকা’আত হিসাবে ইহা তৃতীয় রাকা’আত অতঃপর তৃতীয় রাকা’আতে সূরা-ফাতেহার সহিত কোন সূরা মিলাইবে না। কেননা, ইহা কেরাআতের রাকা’আত ছিল না। আর ইহাতে বৈঠক করিবে। ইহা হইল শেষ বৈঠক। বুঝিবার জন্য বিষয়টি বিস্তারিতভাবে লিখিতেছি।
(মাসবুক যে রাকা’আতের রুকূ পাইয়াছে, সে রাকা’আত পুরাই পাইয়াছে এবং যে রাকা’আতের রুকূ পায় নাই সেই রাকা’আত পড়িবে। কিন্তু জমা’আতে তৎক্ষণাৎ শরীক হইয়া যাইবে। এমনকি, যদি ইমামকে সজদার মধ্যে পায়, তবে সজদার মধ্যেই শরীক হইয়া যাইবে, যদি আত্তাহিয়্যাতুর মধ্যে পায়, আত্তাহিয়্যাতুর মধ্যেই শরীক হইয়া যাইবে। এই অবস্থায় শরীক হইবার নিয়ম এই যে, সোজা দাঁড়াইয়া নিয়্যত করিয়া হাত উঠাইয়া ‘আল্লাহু আকবর’ বলিয়া হাত বাঁধিয়া আবার আল্লাহু আকবর বলিয়া রুকূতে বা সজদায় বা আত্তাহিয়্যাতুর মধ্যে গিয়া শরীক হইবে। যে সব রাকা’আত ছুটিয়া গিয়াছে তাহা সে মুনফারেদের মত আদায় করিবে। অর্থাৎ, তাহার সানা তাআওওয, বিসমিল্লাহ, কেরাআত সব কিছুই পড়িতে হইবে এবং যদি ভুল হয়, তবে ছহো সজদাও করিতে হইবে। যদি কেহ মাগরিবের এক রাকা’আত মাত্র পায়, তবে ইমামের বাম দিকে সালাম ফিরাইবার পর এবং যদি ইমামের ছহো সজদা থাকিয়া থাকে, তবে সজদা করার পর আবার আত্তাহিয়্যাতু পড়িয়া যখন বাম দিকে সালাম ফিরান হইয়া যাইবে, তখন সে উঠিয়া দাঁড়াইবে এবং ছানা, তাআওওয, বিসমিল্লাহ, কেরাআত ইত্যাদি সহ এক রাকা’আত পড়িয়া বসিয়া আত্তাহিয়্যাতু পড়িবে এবং পুনরায় উঠিয়া আর এক রাকা’আত কেরাআতসহ পড়িয়া আত্তাহিয়্যাতু দরূদ দো’আ মাছুরা পড়িয়া শেষে সালাম ফিরাইবে। এইরূপে যদি এশা যোহর বা আছরের মাত্র এক রাকা’আত পায়, তবেও ইমামের সালাম ফিরাইবার পর তাহাকে উঠিয়া এক রাকা’আত কেরাআতসহ পড়িয়া বসিতে হইবে এবং তারপর উঠিয়া এক রাকা’আত কেরাআতসহ এবং এক রাকা’আতে শুধু সূরা-ফাতেহা পড়িবে।)
২৭।মাসআলাঃ যদি কেহ ‘মাসবুকও’ হয় এবং ‘লাহেকও’ হয় তবে সে যে কয় রাকা’আতে লাহেক হইয়াছে তাহা আগে বিনা কেরাআতে পড়িবে (যেন সে ইমামের পিছেই পড়িতেছে)। তারপর যে কয় রাকা’আতে মাসবুক হইয়াছে তাহা কেরাআতসহ পড়িবে (যেন সে একা একা পড়িতেছে); যেমন- যদি কোন মুক্বীম এশার নামাযের এক রাকা’আত হইয়া যাওয়ার পর দ্বিতীয় রাকা’আতে কোন মুসাফির ইমামের পিছে এক্তেদা করে, তবে সে প্রথম রাক’আতের জন্য মাসবুক হইল এবং তৃতীয় ও চতুর্থ রাকা’আতের জন্য লাহেক হইল। অতএব, ইমামের যখন সালাম ফিরান শেষ হইবে, তখন সে দাঁড়াইয়া আগে ৩য় ও ৪র্থ রাকা’আত কেরাআত ছাড়া পড়িবে এবং ইমামের হিসাবে চতুর্থ রাকা’আতের পর বসিয়া আত্তাহিয়্যাতু ‘আবদুহু ওয়া রসূলুহু’ পর্যন্ত পড়িয়া, পুনরায় উঠিয়া প্রথম রাকা’আত কেরাআত সহ পড়িবে এবং বসিয়া আত্তাহিয়্যাতু, দুরূদ ও দো’আ মাছুরা পড়িয়া সালাম ফিরাইবে। যদি কোন ব্যক্তি আছর বা যোহরের নামাযের এক রাকা’আত পড়ার পর দ্বিতীয় রাকা’আতে জমা’আতে দাখিল হয় এবং দাখিল হওয়ার পর রাকা’আত পূর্ণ হইবার পূর্বেই তাহার ওযূ টুটিয়া যায়, তবে তাহার জন্য বেহতের ও আফযল এই যে তৎক্ষণাৎ নামায ছাড়িয়া দিয়া ওযূ করিয়া আসিয়া এক রাকা’আত বা দুই’আত যাহাকিছু পায় তাহাই ইমামের সঙ্গে পড়িয়া অবশিষ্ট রাকা’আতগুলি মাসবুকরূপে পড়ে, (কিন্তু যদি সে ‘বেনা’র মাসআলা উত্তমরূপে অবগত থাকে এবং বেনা করিতে চায়, তবে সে মাসবুকও লাহেক হইবে;) অতএব, ওযূ করিয়া আসিয়া যদি ইমামকে নামাযের মধ্যে পায়, তবে ইমামের সঙ্গে শরীক হইয়া যাইবে এবং ইমাম সালাম ফিরাইবার পর দাঁড়াইয়া যে কয় রাকা’আতে সে লাহেক হইয়াছে তাহা আগে পড়িয়া শেষে প্রথম রাকা’আত যাহা আগেই ছুটিয়া গিয়াছে পড়িবে আর যদি ওযূ করিয়া আসিয়া দেখে যে, ইমাম সালাম ফিরাইয়া ফেলিয়াছে, তবে সে প্রথম এক রাকা’আতে মাসবুক এবং শেষের তিন রাকা’আতে লাহেক হইল। অতএব, সে প্রথমে শেষের এই তিন রাকা’আত সূরা-কেরাআত ছাড়া পড়িবে, যেন সে ইমামের পিছনেই পড়িতেছি; কিন্তু এই তিন রাকা’আতের প্রথম রাকা’আত পড়িয়া বসিয়া আত্তাহিয়্যাতু পড়িবে। কেননা, ইহা ইমামের দ্বিতীয় রাকা’আত; তারপর তৃতীয় রাকা’আত পড়িয়া আবার বসিবে এবং আত্তাহিয়্যাতু পড়িবে। কেননা, ইহা ইমামের চতুর্থ রাকা’আত, তারপর প্রথম রাকা’আত সূরা কেরাআতসহ পড়িবে। কেননা, এই রাকা’আতে সে মাসবুক এবং মাসবুক মুনফারেদের মত কেরাআত পড়িবে। তারপর বসিয়া আত্তাহিয়্যাতু ও দুরূদ পড়িবে ও সালাম ফিরাইবে। কেননা, ইহা তাহার শেষ রাকা’আত।
২৮।মাসআলাঃ ইমামের সঙ্গে সঙ্গেই নামাযের সমস্ত রোকন আদায় করা মুক্তাদীদের জন্য সুন্নত, দেরী করা উচিত নহে। তাহরীমা, রুকূ, ক্বওমা, সজদা ইত্যাদি সব রোকনই ইমামের সঙ্গে সঙ্গেই আদায় করিবে; দেরী করিবে না (আগে ত করিবেই না) কা’দায়ে উলা অর্থাৎ, প্রথম বৈঠকে যদি মুক্তাদীর আত্তাহিয়্যাতু পুরা হইবার পূর্বেই ইমাম দাঁড়াইয়া যায়, তবে মুক্তাদী আত্তাহিয়্যাতু পুরা না করিয়া দাঁড়াইবে না, পুরা করিয়া তারপর দাঁড়াইবে। এইরূপে ক্বা’দায়ে আখিরাতে অর্থাৎ শেষ বৈঠকে যদি (ঘটনাক্রমে) মুক্তাদী আত্তাহিয়্যাতু অর্থাৎ, আবদুহু ওয়া রাসূলুহু পর্যন্ত পুরা করিবার পূর্বেই ইমাম সালাম ফিরায়, তবে মুক্তাদী সালাম ফিরাইবে না, আত্তাহিয়্যাতু পুরা করিয়া তারপর সালাম ফিরাইবে। কিন্তু যদি রুকূ বা সজদায় মুক্তাদী তসবীহ পূর্ণ করিবার পূর্বেই ইমাম উঠিয়া যায়, তবে ইমামের সঙ্গে সঙ্গেই উঠিবে। (অবশ্য বিনা কারণে ইমামের বেশী জলদী করা উচিত নহে বা মুক্তাদীরও অলস বা অমনোযোগী হওয়া ঠিক নহে! আবার যদি কোন কারণ বশতঃ মুক্তাদীও কিছু দেরী করিয়া ফেলে তাহাতে তাহার নামায বাতিল হইবে না।)
No comments: