ঈদের নামায
ঈদের নামায
ঈদের নামায
১।মাসআলাঃ শাওয়াল চাঁদের প্রথম তারিখে একটি ঈদ, তাহাকে ‘ঈদুল ফিৎর’ এবং যিলহ্জ্জ চাঁদের ১০ই তারিখে একটি ঈদ, তাহাকে ‘ঈদুল আযহা’ বলে। ঈদ অর্থখুশী। ইসলাম ধর্মের বিধানে দুইটি ঈদ নির্ধারিত হইয়াছে। এই উভয় ঈদের দিনে (মহাসমারোহে সমস্ত) মুসলমানের একত্রিত হইয়া শোকর আদায়ের জন্য দুই রাকাআত নামায পড়া ওয়াজিব। জুমুআর নামাযের জন্য যে সব শর্ত, দুই ঈদের নামাযের জন্যও সেই সব শর্ত যরূরী। কিন্তু জুমাআর নামাযের খুৎবা ফরয, দুই ঈদের নামাযের খুৎবা সুন্নত। জুমুআর খুৎবার ন্যায় দুই ঈদের খুৎবা শুনাও ওয়াজিব, খুৎবা চুপ করিয়া কান লাগাইয়া শুনিতে হইবে, কথাবার্তা বলা, চলাফেরা করা, নামায পড়া বা দোআ করা সবই হারাম।
ঈদুল ফিৎরের দিন ১৩টি কাজ সুন্নত। যথাঃ
(১)শরীঅতের সীমার মধ্যে থাকিয়া যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া (এবং খুশী যাহির করা।) (২) গোসল করা (৩) মিসওয়াক করা (৪) যথাসম্ভব উত্তম কাপড় পরিধান করা (৫) খোশবু লাগান (৬) সকালে অতি প্রত্যুষে বিচানা হইতে গাত্রোত্থান করা (৭) ফজরের নামাযের পরেই অতি ভোরে ঈদগাহে যাওয়া (৮) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খোরমা অথবা অন্য কোন মিষ্টি দ্রব্য ভক্ষণ করা। (৯) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে ছদকায়ে ফিৎরা দান করা। (১০) ঈদের নামায মসজিদে না পড়িয়া ঈদগাহে গিয়া পড়া। অর্থাৎ, বিনা ওযরে শহরের মসজিদে না পড়া। (১১) ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া ও অন্য রাস্তায় ফিরিয়া আসা। (১২) ঈদগাহে পায়ে হাঁটিয়া যাওয়া। (১৩) ঈদাহে যাইবার সময় আস্তে আস্তে নিম্নলিখিত তকবীর বলিতে বলিতে যাওয়া।
[আরবি]
২।মাসআলাঃ ঈদুল ফিৎরের নামায পড়িবার নিয়্যতঃ
[আরবি]
“আমি ঈদুল ফিৎরের দুই রাকাআত নামায ঈদের ছয়টি ওয়াজিব তকবীরসহ পড়িতেছি।”
এইরূপ নিয়্যত করিয়া, ‘আল্লাহ আকবর’ বলিয়া হাত উঠাইয়া তাহরীমা বাঁধিবে। তারপর সোবহানাকা পুরা পড়িবে। (কিন্তু আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ পড়িবে না।) তারপর পর পর তিনবার ‘আল্লাহ আকবর’ বলিয়া তকবীর বলিবে এবং প্রত্যেকবার হাত কান পর্যন্ত উঠাইয়া ছাড়িয়া দিবে। প্রত্যেক তকবীরের পর তিনবার সোবহানাল্লাহ বলা যায় পরিমাণ সময় থামিবে। (জমাআত বড় হইলে এরচেয়ে কিছু বেশীও দেরী করা যায়) তৃতীয়বার তকবীর বলিয়া হাত ছাড়িবে না। দুই হাত বাঁধিয়া তাহরীমা বাঁধিয়া লইবে। তারপর আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পড়িয়া সূরা-ফাতিহা এবং অন্য একটি সূরা পড়িয়া অন্যান্য নামাযের ন্যায় রুকূ-সজদা করিবে, কিন্তু দ্বিতীয় রাকাআতে দাঁড়াইয়া সূরা-ফাতিহা ও অন্য সূরা পড়িবার পর সঙ্গে সঙ্গে রুকূতে যাইবে না; বরং উপরোক্ত নিয়মে তিনবার তকবীর বলিবে। তৃতীয় তকবীর বলিয়া হাত বাঁধিবে না; বরং হাত ছাড়িয়া রাখিয়া চতুর্থ তকবীর বলিয়া রুকূতে যাইবে।
৩।মাসআলাঃ নামাযের পর ইমাম মিম্বরের উপর দাঁড়াইয়া দুইটি খুৎবা পড়িবে। দুই খুৎবার মাঝখানে জুমুআর খুৎবার ন্যায় কিছুক্ষণ বসিবে। (ঈদুল ফিৎরের খুৎবার মধ্যে ছদক্বায়ে ফিৎর সম্বন্ধে আহকাম বয়ান করিবে। মুক্তাদী দূরত্বের কারণে খুৎবা না শুনিতে পাইলে চুপ করিয়া কান লাগাইয়া থাকা ওয়াজিব।
৪।মাসআলাঃ ঈদের নামাযের (বা খুৎবার) পরে দোআ করা যদিও নবী (দঃ) ও তাঁহার ছাহাবা এবং তাবেযীন ও তাবে-তাবেয়ীন হইতে প্রমাণিত নয়; কিন্তু অন্যান্য নামাযের পর দোআ করা যেহেতু সুন্নত, অতএব, ঈদের নামাযের পরও দোআ করা সুন্নত হইবে বলিয়া ধারণা।
৫।মাসআলাঃ উভয় ঈদের খুৎবা প্রথমে তকবীর বলিয়া আরম্ভ করিবে। প্রথম খুৎবায় ৯ বার আল্লাহু আকবর বলিবে। দ্বিতীয় খুৎবায় ৭ বার বলিবে।
৬।মাসআলাঃ ঈদুল আযহার নামাযের নিয়মও ঠিক ঈদুল ফিৎরের নামাযের অনুরূপ এবং যে সব জিনিস ওখানে সুন্নত সেইসব এখানেও সুন্নত। পার্থক্য শুধু এই যে, (১) নিয়্যতের মধ্যে ঈদুল ফিৎরের পরিবর্তে ‘ঈদুল আযহা’ বলিবে, (২) ঈদুল ফিৎরের দিন কিছু খাইয়া ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত, কিন্তু ঈদুল আযহার দিনে খাইয়া যাওয়া সুন্নত নহে। (বরং ঈদুল আযহার নামাযের পূর্বে কিছু না খাইয়া যাওয়াই মোস্তাহাব), (৩) ঈদুল আযহার দিনে ঈদগাহে যাইবার সময় উচ্চস্বরে তকবীর পড়া সুন্নত। ঈদুল ফিৎরে আস্তে পড়া সুন্নত, (৪) ঈদুল আযহার নামায ঈদুল ফিৎর অপেক্ষা অধিক সকালে পড়া সুন্নত, (৫) ঈদুল ফিৎরে নামাযের পূর্বে ছদক্বায়ে ফিৎর দেওয়ার হুকুম; ঈদুল আযহার নামাযের পর সক্ষম ব্যক্তির কোরবানী করার হুকুম; ঈদুল ফিৎর এবং ঈদুল আযহা, এই দুই নামাযের কোন নামাযেই আযান বা এক্বামত নাই।
৭।মাসআলাঃ ঈদের দিন ঈদগাহে, মসজিদে বা বাড়িতে ঈদের নামাযের পূর্বে অন্য কোন নফল নামায পড়া মাকরূহ। অবশ্য ঈদের নামাযের পর বাড়িতে বা মসজিদে নফল পড়া মকরূহ নহে।
৮।মাসআলাঃ স্ত্রীলোকগণ এবং অন্যান্য যাহারা কোন ওযরবশতঃ ঈদের নামায পড়ে নাই তাহাদের জন্যও ঈদের নামাযের পূর্বে কোন নফল পড়া মকরূহ।
৯।মাসআলাঃ ঈদুল ফিৎরের খুৎবায় ছদক্বায়ে ফিৎর সম্বন্ধে এবং ঈদুল আযহার খুৎবায় কোরবানী ও ‘তকবীরে তশরীক’ সম্বন্ধে বর্ণনা করিতে হইবে। নিম্ন তকবীরকে ‘তকবীরে তশরীক’ বলেঃ
[আরবি]
পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের পর এই তকবীর বলা ওয়াজিব; যদি সে ফরয শহরে জমাআতে পড়া হয়। স্ত্রীলোক ও মুসাফিরের উপর এই তকবীর ওয়াজিব নহে। যদি ইহারা এমন কোন লোকের মুক্তাদী হয়, যাহাদের উপর তকবীর ওয়াজিব, তবে ইহাদের উপরও ওয়াজিব হইবে। কিন্তু যদি একা নামাযী এবং স্ত্রীলোক ও মুসাফির পড়ে, তবে ভাল। কেননা ছাহেবাইনের মতে ইহাদের উপরও ওয়াজিব।
১০।মাসআলাঃ ৯ই যিলহজ্জ (হজ্জের দিন) ফজর হইতে ১৩ই যিলহজ্জ আছর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাযের পর যাহারা জমাআতে নামায পড়ে তাহাদের সকলের উপর একবার ‘তকবীরে তশরীক’ বলা ওয়াজিব।
১১।মাসআলাঃ এই তকবীর উচ্চ শব্দে বলা ওয়াজিব; স্ত্রীলোক নিঃশব্দে বলিবে।
১২।মাসআলাঃ নামাযের পর বিলম্ব না করিয়া তৎক্ষণাৎ এই তকবীর বলিতে হইবে।
১৩।মাসআলাঃ যদি ইমাম তকবীর বলিতে ভুলিয়া যায়, তবে মুক্তাদীগণ উচ্চ স্বরে তকবীর বলিয়া উঠিবে; ইমামের অপেক্ষায় বসিয়া থাকা উচিত নহে।
১৪।মাসআলাঃ ঈদুল আযহার নামাযের পরও তকবীর বলা মতান্তরে ওয়াজিব।
১৫।মাসআলাঃ উভয় ঈদের নামায সমস্ত শহরের লোকের একত্রে এক জায়গায় পড়াই উত্তম। কিন্তু যদি কয়েক জায়গায় পড়ে, তবুও নামায হইয়া যাইবে। সকলের ঐক্যমতে বিভিন্ন মসজিদে পড়া জায়েয।
১৬।মাসআলাঃ যদি কেহ একাকী ঈদের নামায না পায়, অথবা নামায পাইয়াছিল কিন্তু কোন কারণবশতঃ একজন লোকের নামায ফাসেদ হইয়া গিয়াছে, তবে একা একা ঈদের নামায বা তাহার ক্বাযা পড়িতে পারিবে না এবং ক্বাযা পড়া ওয়াজিবও হইবে না। কেননা, ঈদের নামায ছহীহ হওয়ার জন্য জমাআত শর্ত। অবশ্য যদি একদল লোকের নামায ছুটিয়া যায় বা ফাসেদ হইয়া যায়, তবে তাহারা (পূর্ববর্তী ইমাম ও মুক্তাদী ছাড়া) অন্য কাহাকেও ইমাম বানাইয়া নামায পড়িবে।
১৭।মাসআলাঃ যদি কোন ওযরবশতঃ ১লা শাওয়াল (দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত) ঈদুল ফিৎরের নামায না পড়া হয়, তবে ২রা তারিখেও পড়িতে পারে। তারপর আর পারিবে না। আর ঈদুল আযহার নামায যদি কোন ওজরবশতঃ ১০ই তারিখে না পড়িতে পারে, তবে ১১ই বা ১২ই তারিখ পর্যন্তও পড়িতে পারে।
১৮।মাসআলাঃ ঈদুল আযহার নামায যদিও বিনা ওযরে ১০ই তারিখে না পড়া মকরূহ, তবুও যদি কেহ প্রথম দিন না পড়িয়া ২য় বা ৩য় দিনে পড়ে, তবে নামায হইয়া যাইবে। বিনা ওযরে যদি কেহ ১লা শাওয়ার ঈদুল ফিৎরের নামায না পড়িয়া ২রা শাওয়ালে পড়ে, তবে তাহার নামায আদৌ হইবে না।
ওযর যথাঃ(১) যদি কোন কারণবশতঃ ইমাম উপস্থিত না হইতে পারে, (২) অনবরত বৃষ্টি হইতে থাকে, (৩) ওয়াক্ত থাকিতে চাঁদ উঠা নির্ধারিত না হইয়া থাকে, ওয়াক্ত চলিয়া গেলে তারপর চাঁদ উঠার খবর পাইয়া থাকে। (৪) নামায পড়া হইয়াছে কিন্তু আকাশে মেঘ থাকায় সঠিক ওয়াক্ত জানা যায় নাই, পরে মেঘ সরিয়া গেলে জানা গেল যে, তখন নামাযের ওয়াক্ত ছিল না।
১৯।মাসআলাঃ ঈদের নামাযে যদি কেহ ইমামের তকবীর বলা শেষ হওয়ার পর নামাযে শরীক হয়, তবে যদি ইমামকে দাঁড়ান অবস্থায় কেরাআতের মধ্যে পায়, তবে নিয়্যত বাঁধিয়া একা একা তকবীর বলিয়া লইবে, আর যদি ইমামকে রুকুর মধ্যে পায়, তবে যদি মনে দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, তকবীর বলিয়াও ইমামকে রুকূর মধ্যে পাইবে, তবে দাঁড়ান অবস্থায় নিয়্যত করিয়া তকবীর বলিয়া তারপর রুকূতে যাইবে, আর যদি তকবীর বলিলে রুকূ না পাইবার আংশকা থাকে, তবে নিয়্যত বাঁধিয়া রুকূতেই চলিয়া যাইবে, কিন্তু রুকূতে রুকূর তসবীহ না পড়িয়া আগে তকবীর বলিয়া লইবে, তারপর সময় পাইলে রুকূর তসবীহ পড়িবে। কিন্তু রুকূতে তকবীর বলিতে হাত উঠাইবে না। যদি তকবীর শেষ করার পূর্বেই ইমাম রুকূ হইতে মাথা উঠাইয়া ফেলে, তবে মুক্তাদীও দাঁড়াইয়া যাইবে, যে পরিমাণ বাকী থাকে তাহা মাফ।
২০।মাসআলাঃ ঈদের নামাযে যদি কেহ দ্বিতীয় রাকাআতে শামিল হয়, তবে ইমাম সালাম ফিরাইলে সে যখন প্রথম রাকাআত পড়িবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইবে, তখন সে প্রথমে ছানা, তাআওউয, সূরা-কেরাআত পড়িবে, তারপর রুকূর পূর্বে তকবীর বলিবে, কেরাআতের পূর্বে তকবীর বলিবে না।
ইমাম যদি দণ্ডায়মান অবস্থায় তকবীর বলা ভুলিয়া যায় এবং রুকূর অবস্থায় মনে আসে, তবে রুকূর মধ্যেই তকবীর বলিবে। রুকূ ছাড়িয়া দাঁড়াবে না। কিন্তু যদি রুকু ছাড়িয়া দিয়া দাঁড়াইয়া তকবীর বলিয়া আবার ‘রুকূ’ করে, তাহাতেও নামায হইয়া যাইবেনামায ফাসেদ হইবে না, লোক সংখ্যার আধিক্যের কারণে ছহো সজদাও করিতে হইবে না।
No comments: