হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কর্তৃক ইয়াজিদকে খলিফা মনোনয়ন ছিল ইসলামী শাসন ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত
হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) কর্তৃক ইয়াজিদকে খলিফা মনোনয়ন ছিল ইসলামী শাসন ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত
মহানবী (দঃ) ইন্তেকালের পূর্বে কাউকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাননি। তিনি জনগনের উপর তার উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ভার ছেড়ে দিয়ে যান। সেইমতে প্রথম চারজন উত্তরাধিকারী তথা খোলাফায়ে রাশেদীন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগন কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু উমাইয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুয়াবিয়া খিলাফত লাভের সাথে সাথে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন। ৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দে বসরার শাসনকর্তা হযরত মুগিরার প্ররোচনায় তিনি তার জ্যৈষ্ট পুত্র ইয়াজিদকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার মর্মমুলে চরম কুঠারাঘাত করেন। হযরত মুয়াবিয়া এবং হযরত মুগীরা উভয়েই সম্মানিত সাহাবী ছিলেন।
যেহেতু তারা কোন নবী বা রসুল ছিলেন না, স্বাভাবিক কারনেই তারা ভুলের উর্ধ্বে ছিলেন না। কিন্তু তাদের এই ভুল ইসলামের ইতিহাসকে ক্ষত বিক্ষত, রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত করে। ইসলামের শাসন পদ্ধতির মুলে চরম কুঠারাঘাত করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর পুত্র ইয়াজিদ ছিল নিষ্ঠুর, বিশ্বাসঘাতক, অধার্মিক ও মদ্যপায়ী। হযরত মুয়াবিয়ার সম্মানার্থে অনেকেই বলেন তিনি যখন তার পুত্রকে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন, তখন ইয়াজিদ নাকি এমন দুরাচারী ছিল না। মুয়াবিয়া মৃত্যুর পরই নাকি সে এমন হয়েছে। হতে পারে, আল্লাহই ভাল জানেন।
ঐতিহাসিক আল-ফাখরী, ফন ক্রেমার এবং ইবনুত তিকতাকার মতে ইয়াজিদের রাজত্বকাল তিনটি দুষ্কর্মের জন্য বিখ্যাত-প্রথম বছরে সে মহানবীর আদরের দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইনকে হত্যা করে, দ্বিতীয় বছরে মদীনাকে লুন্ঠন করে এবং তৃতীয় বছরে সে কাবার উপর হামলা করে।
এই পাপাচারী ইয়াজিদ-এর খলিফা হিসাবে মনোনয়ন অন্যরা মেনে নিলেও, ইসলামের ব্যত্যয় মহানবীর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন মেনে নিলেন না। হুসাইনের এই ন্যায্য দাবীকে আবদুল্লাহ-ইবনে যুবাইর, আবদুল্লাহ-ইবনে ওমর, আবদুর রহমান-ইবনে আবু বকর সমর্থন করেন। অবশ্য কিছুদিন পর শেষোক্ত দুজন ইয়াজিদের প্রলোভনে পড়ে তার বশ্যতা স্বীকার করে নেন। ইয়াজিদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হুসাইন এবং আবদুল্লাহ-ইবনে যুবাইর মক্কায় চলে যান।
কারবালার ঘটনা:
ইয়াজিদ ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটানোয় ইমাম হুসাইনের মত মুমীন ব্যক্তির পক্ষে সেটা মেনে নেয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবনই ছিল ইমাম হোসাইনের (রা.) সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থনও ছিল তার পক্ষে। উপরন্তু কুফাবাসীগন ইয়াজিদের অপশাসনের হাত থেকে বাচার জন্যে বারংবার ইমাম হুসাইন-এর সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকলে তিনি তাতে সাড়া দেন। তিনি কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কুফার অবস্থা জানার জন্যে হুসাইন তার চাচাতো ভাই মুসলিম-বিন-আকিলকে সেখানে প্রেরণ করেন। মুসলিম কুফাবাসীর সাহায্যের আশ্বাস পেয়ে ইমাম হুসাইনকে কুফায় আসতে অনুরোধ করে পত্র লিখেন।
কিন্তু এরিমধ্যে ইয়াজিদের অধিনস্থ ইরাকের শাসনকর্তা কঠিন হৃদয়ের ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ মুসলিমকে খুঁজে বের করে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং তাকে সহায়তাকারীদেরও খুঁজে হত্যা করে। এতে কুফাবাসীরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা হুসাইনের সাহায্যে এগিয়ে আসতে আর সাহস পেলো না। কুফাবাসীরা ইমাম হুসাইনকে খলিফা হিসাবে দেখতে চাইলেও ইমাম হুসাইনের জন্য প্রাণ বিসর্জণ দিতে রাজি ছিল না। ইয়াজিদের নির্মমতার কথা জেনেও ইমাম হোসাইন (আ) এর সঙ্গীরা যে জেনে শুনে বুঝেই ইমামের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। ইমামকে ভালোবেসে, তাঁর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই তাঁরা ইমামের সাথে থেকে প্রাণপণে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন।
ইমাম হোসাইন (আ) এবং তাঁর সঙ্গীদের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তরবারীর সেই আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি কষ্টকর ছিল জনগণের অজ্ঞতা এবং মূর্খতার আঘাত। সেজন্যেই জনতার চিন্তার ভূবন থেকে অজ্ঞতার পর্দা অপসারণ করাটাই ছিল তাদেঁর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ।
মুসলিম প্রেরিত পত্র পেয়ে ইমাম হুসাইন স্ত্রী, পুত্র কন্যা, আত্মীয়-স্বজন এবং ২০০ অনুচর সহ কুফার পথে রওনা হন। কুফার ইয়াজিদ বাহিনীর সেনাপতি ওমর হুসাইনকে ইয়াজিদের আনুগত্যের শপথ গ্রহনের নির্দেশ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা ফোরাত নদীর তীর ঘিরে দর্ন্ডায়মান হলো এবং হুসাইন শিবিরের পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিলো।
তাসূয়ার দিনে কারবালার পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ইমামের সঙ্গীরা অবিচল আস্থা ও ইমানের সাথে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। চরম সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও তাঁরা ইমামের সাথে কৃত তাদেঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেননি। এই অনড় ইমানের অধিকারী একজন ছিলেন হযরত আব্বাস (আ)। তিনি ছিলেন হযরত আলি (আ) এর ছেলে।
তাঁর মা ছিলেন উম্মুল বানিন। হযরত আব্বাস ছিলেন অকুতোভয় এক যুবক। তাঁর ইমান, বীরত্ব, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলির কথা ছিল প্রবাদতুল্য। দেখতেও তিনি ছিলেন খুব সুন্দর। কারবালার অসম যুদ্ধে তিনিই ছিলেন ইমামপক্ষের প্রধান সিপাহসালার। ইমামের প্রতিরক্ষায়, নারী ও শিশুদের তাঁবুর প্রতিরক্ষায় এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর সন্তানদের জন্যে পানির ব্যবস্থা করতে প্রাণপণে লড়েছেন তিনি।
অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইবেন যিয়াদের ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইনকে (রা.) অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। মাত্র ২০০ মানুষের বিপক্ষে ৪০০০ সৈন্য। পানি সরবরাহের পথ বন্ধ করে দেয়ায় ইমামের কচি সন্তানেরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লে হযরত আব্বাস (আ) ফোরাতে যান পানি আনতে। নিজেও তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলেন। আঁজলা ভরে পানি তুলে খেতে যাবেন এমন সময় তাঁর মনে পড়ে যায় ইমাম হোসেন (আ.) এর তৃষ্ণার্ত শিশু সন্তানের কথা।
পানি ফেলে দিয়ে মশক ভর্তি করে তাঁবুর উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই শত্রুপক্ষের তীরে তাঁর এক হাত কেটে যায়। মশকটাকে তিনি অপর হাতে নিয়ে ইমামের তাঁবুর দিকে ছুটলেন। এবার অপর হাতটিও কাটা পড়ে। মশকটাকে এবার তিনি মুখে নিয়ে তাঁবুর দিকে যেতে চাইলেন। শত্রুর তীর এবার সরাসরি তার দেহে আঘাত হানে। এভাবে শহীদ হয়ে যান তিনি। এরপর অসম এই যুদ্ধে আলী আকবর শহীদ হয়ে যান। কারবালায় আরো যাঁরা শহিদ হন তাদেঁর মধ্যে রাসূলের প্রিয় সাহাবা হাবিব ইবনে মাজাহের, তাঁর প্রাচীন বন্ধু মুসলিম ইবনে আওসাজা, নওমুসলিম ওহাবসহ আরো অনেকেই।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দুরাবস্থায় পতিত হয়ে হুসাইন ওবায়দুল্লাহর নিকট তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটা গ্রহনের অনুরোধ জানান। তাহলো-হয় তাকে মদীনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক, কিম্বা তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক, বা ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্যে দামেস্কে যেতে দেয়া হোক। কিন্তু ক্ষমতাদর্পী ওবায়দুল্লাহ এর কোনটাই মানলো না। এদিকে পানির অভাবে হুসাইন শিবিরে হাহাকার পড়ে গেলো। ছোট শিশুরা মুর্ছা যেতে লাগলো। নিরুপায় হুসাইন শেষবারের মত অনুরোধ করলেও, পাষান্ডদের মন গলেনি।
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর কারবালার প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধ শুরু হলো। হুসাইনের ভ্রাতুষ্পুত্র কাশিম সর্বপ্রথম শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরন করলেন। তৃষ্ণার্ত হুসাইন শিশুপুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে ফোরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলেন কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীর শিশুপুত্রের শরীরে বিদ্ধ হয়ে শিশুপুত্রটি শাহাদাত বরন করলে একাকী অবসন্ন হুসাইন তাবুর সামনে বসে পড়লেন। এমন সময় এক মহিলা তাকে এক পেয়ালা পানি এনে দিলো। কিন্তু শত্রুর তীর তার মুখ বিদীর্ণ করে দিলো। সীমার নামীয় ইয়াজিদের এক সৈন্য তরবারীর আঘাতে হুসাইনের মস্তক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলো। এই ভয়ন্কর দৃশ্যে কঠিন হৃদয়ও বিগলিত হলো।
হুসাইন পরিবারের জীবিত সদস্যদের বন্দী করে দামেস্কে ইয়াজিদের নিকট পাঠানো হয়। এদিকে হুসাইনের মৃত্যুর এমন ভয়াবহ দৃশ্য পুরো দেশের মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলল। ইয়াজিদ ভয় পেয়ে গেলো। ক্ষমতা নিরাপদ রাখতে এবং জনরোষের ভয়ে কৌশলী ভুমিকায় সে বন্দিদের মুক্ত করে মদীনায় পাঠিয়ে দিলো।
শহীদে কারবালার ঘটনাকে কেউ দেখেন আশেকে আহলি বাইতি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিকোণ থেকে, কেউ দেখেন সিয়াসাত অর্থাৎ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কেউ শিয়ায়িজম থেকে, কেউ আহলে সুন্নাত/আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের দৃষ্টিকোণ থেকে। আহলে সুন্নাত/আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত এ ক্ষেত্রে মধ্যপন্থায় বিষয়টি বিবেচনা করে থাকেন। মধ্যপন্থা উত্তম, মধ্যপন্থা নবুয়তের ছেচল্লিশ ভাগ। তাঁরা দেখছেন একদিকে আশেকে আহলি বাইতি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যদিকে আশেকে রিদ্বয়ানুল্লাহ অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামদের আশেক হিসাবে। সেমতে তারা একদিকে ইয়াজিদের প্রতি নেতিবাচক,অন্যদিকে কাতেবে ওয়াহি আমিরে মুয়াবিয়ার প্রতি ইতিবাচক-এ কারণে মধ্যপন্থি। তবে খড়গহস্ত ইয়াজিদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত যা নতুন আরেক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটিয়েছে আশেকে ইয়াজিদরূপে। আমিরে মুয়াবিয়ার শান মান রক্ষার্থে। আমিরে মুয়াবিয়ার প্রতি সিয়াসাত বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারীদের ক্ষোভ তিনি ইসলামী গণতন্ত্রকে ব্যাহত করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইসলাম কোন তন্ত্রে মন্ত্রে নয় বরং ন্যায়পরায়ণতাই ইসলামী সিয়াসাত বা রাজনৈতির ভিত্তি। হোক তা রাজতন্ত্রে, হোক তা গণতন্ত্রে। আরশের ছায়া যে সাত জন পাবেন তার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছেন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ বা শাসক। সোলায়মান আলাইহিমুস সালাম রাজতন্ত্রিক বাদশাহ ছিলেন। সেকান্দর তিনিও বাদশাহ ছিলেন। লক্ষ্যণীয় যে, হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহ পরবর্তী ছয় মাস মেয়াদকালীন শাসক যিনি ছিলেন তিনি হচ্ছেন তদীয় সন্তান হযরত হাসান রদ্বিয়াল্লাহু আনহু। অতঃপর চুক্তিমতে স্বেচ্ছায় শাসন ক্ষমতা আমিরে মুয়াবিয়ার নিকট হস্তান্তর করা হয়।
ReplyDelete