তাওবা-এর প্রকার
তাওবা-এর প্রকার
তাওবা দু’প্রকার।
এক. তাওবাতুল ইনাবাহ্: এ প্রকার তাওবা হলো তোমার উপর আল্লাহর ক্ষমতার কারণে তাকে ভয় করে তার কাছে ফিরে আসা।
দুই: তাওবাতুল ইস্তিজাবা: এ প্রকার তাওবা হলো আল্লাহ তোমার নিকটে আছে এ কারণেই আল্লাহর নিকট হতে লজ্জিত হয়ে ফিরে আসা।[23]
ইমাম গাযালী (রহ.) তাওবাকে চার প্রকারে বিভক্ত করেন:
এক. বান্দাহ তাওবা করবে এবং স্বীয় তাওবার উপরে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অবিচল থাকবে। অন্যায়, ত্রুটি-বিচ্যুতি যা হয়ে গেছে তার সাধ্যমত ক্ষতিপূরণ করবে এবং পরবর্তী সময় তার মনে মানুষের স্বভাবজাত চাহিদাগত সাধারণ ছোটখাট বিচ্যুতি ব্যতিরেকে কোনো গুনাহ সংঘটনের কল্পনাও উদিত হয় না। এ শ্রেণীর বান্দাহকে সাবিকুম বিল খায়রাতে নামে অভিহিত করা হয়। এ প্রকারের তাওবাকে বলা হয় আত-তাওবাতুন-নাসূহ “নির্ভেজাল-পরিচ্ছন্ন তাওবা” এবং মন ও প্রবৃত্তির এই অবস্থার মান হলো আন নাফসুল মুতমাইন্না( النفس المطمئنة )
দুই. তাওবাকারী প্রধান ও মৌলিক ইবাদতসমূহ যথাযথ আদায় করতে থাকে এবং বড় ধরনের অশ্লীলতা হতে আত্মরক্ষা করে থাকে। কিন্তু তার অবস্থা এই যে, সে সকল গুনাহ থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না যা তার পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থানের কারণে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাকে পেয়ে বসে। সে নিজের প্রবৃত্তিকে তিরস্কার ও ভৎর্সনা করতে থাকে এবং অনুতপ্ত হয়। গুনাহর কার্য সম্পাদনের পর পর পুনঃ এ সংকল্প করে যে, সামাজিক ও পরিবেশগত যেই পরিস্থিতির কারণে তার দ্বারা এ গুনাহ সংঘটিত হলো তা হতে সে দূরে অবস্থান করবে এবং নিজেকে রক্ষা করে চলবে। এই প্রকৃতির প্রবৃত্তিকে আন-নাফসুল লাওয়ামা(النفس اللوامة) বলা হয়। তাওবাকারীগণ এই দলভুক্ত সাব্যস্ত হয়ে থাকেন।
তিন. তাওবাকারী তাওবার পরে বেশ দীর্ঘদিন তার উপরে অবিচল থাকে। পরে কোনও পাপ তাকে বশীভুত করে ফেলে এবং সে তাতে লিপ্ত হয়।
চার. পাপ সংঘটনকারী ব্যক্তি তাওবা করার পর পুনরায় বিভিন্ন পাপ কার্যে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। এমনকি তার মনে তার তাওবার চিন্তা উদিত হয় না এবং তার মনে কোনো প্রকার আক্ষেপ, অনুতাপও জাগ্রত হয় না, বরং সে প্রবৃত্তির কু-চাহিদার গোলামে পরিণত হয়। এ ধরনের প্রবৃত্তিকে আন ‘আন-নাফসুল আম্মারা বিস সূ’ বলা হয়।[24]
ইমাম গাযালী (র)-এর মতে প্রত্যেক মু‘মিনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে (على الفور) ও অবিলম্বে এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাওবায় অভ্যস্ত থাকা ওয়াজিব। কেননা কোনও আদম সন্তানই পাপমুক্ত নয়। তার পাপগুলো ঈমানের জন্য বিধ্বংসী উপকরণরূপে সাব্যস্ত। মানুষ হয়ত তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা পাপ সংঘটিত করে কিংবা তার মনঃজগতে পাপের ইচ্ছা জন্ম নেয় কিংবা শয়তানী কুমন্ত্রণা তাকে কখনও না কখনও আল্লাহ তা‘আলার যিকর হতে অমনোযোগী করে ফেলে। এসব হলো নেতিবাচক উৎসের পাপ। এগুলো হতে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হলেও আল্লাহর আহকাম পালন এবং আল্লাহ তা‘আলার সত্ত্বা ও তাঁর গুণাবলী ও ক্রিয়াকর্মের পরিচিতি লাভে অভাব থেকে যেতে পারে। কেননা, কোন মানুষ এ সকল দুর্বলতা ও ত্রুটি হতে মুক্ত ও পবিত্র হওয়া এবং এর কোন একটিও তার মধ্যে না থাকা অকল্পনীয় ও প্রায় অসম্ভব ব্যাপার।
যে কোনো তাওবা যথার্থ হলে আল্লাহ তা‘আলা তা গ্রহণ করেন। এখানে প্রসঙ্গত এ আলোচনা এসে পড়ে যে, তাওবা কবুল করা আল্লাহর জন্য অপরিহার্য ও আবশ্যকীয় হবে কী? মু‘তাযিলা সম্প্রদায়ের দাবীমতে তাওবা কবুল করা আল্লাহর জন্য অবশ্যই কর্তব্য ওয়াজিব। আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের মতে আল্লাহর জন্য কোন বিধান অপরিহার্য নয়। ইমাম গাযালী (রহ.) মু‘তাযিলাদের ঐ বাতিল মতবাদ এভাবে খণ্ডন করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাওবা করাকে পাপ মার্জনার মাধ্যম সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং সেই ব্যক্তি তাওবার শর্তাবলী পূরণ করবে তার জন্য তাওবা কবুল করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার অঙ্গীকার রয়েছে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ وَإِنِّي لَغَفَّارٞ لِّمَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا ثُمَّ ٱهۡتَدَىٰ ٨٢ ﴾ [طه: ٨٢]
‘এবং যেই ব্যক্তি তাওবা করে ও ঈমান এনে পুণ্য কার্য করে আমি তার পাপের জন্য বড়ই ক্ষমাশীল।’ [25] সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা স্বঘোষিত বিষয় ও তাঁর স্বেচ্ছাপ্রদত্ত ক্ষমার সুযোগ প্রদানকে তাঁরই জন্য অপরিহার্য সাব্যস্ত করা তথা বাহির হতে তাঁর উপর চাপ সৃষ্টি করার মতবাদ নিতান্ত হাস্যকর। এটি স্বতন্ত্র ব্যাপার যে, আল্লাহ নিজেকেই তাওবাকারীদের ক্ষমা করবার ওয়াদা করেছেন এবং আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ওয়াদা পূর্ণ করে থাকেন।
তিনি বলেন:
﴿ أَلَآ إِنَّ وَعۡدَ ٱللَّهِ حَقّٞ ﴾ [يونس: ٥٥]
“জেনে রাখ, আল্লাহর ওয়াদা সত্য”[26] এবং তিনি কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
তিনি বলেন:
﴿ وَلَن يُخۡلِفَ ٱللَّهُ وَعۡدَهُۥۚ ﴾ [الحج: ٤٧]
‘এবং আল্লাহ কখনও তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।’[27] সুতরাং তাওবা কবুল করা শুধু তাঁর মেহেরবানী সূচিত ওয়াদা পূর্ণ করার ব্যাপার।
No comments: