কোন তাওবাহ কাজে লাগে আর কোনটি কাজে লাগে না?
কোন তাওবাহ কাজে লাগে আর কোনটি কাজে লাগে না?
আহলুস-সুন্নাহর আলেমগণ বলেন: তাওবার শর্ত তিনটি। তাৎক্ষণিকভাবে গোনাহ ছেড়ে দেওয়া, ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা, অতীত কর্মে অনুশোচনা করা। এ জাতীয় তাওবাই মূলত ‘তাওবাতুন নাসূহ’।
হাসান আল-বাসরী (রহ.) বলেন:
ندم بالقلب ، واستغفار باللسان ، وترك بالجوارح ، وإضمار أن لا يعود.
‘তাওবায়ে নাসূহ হলো, হৃদয়ে অনুশোচনার জবাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে গোনাহ পরিত্যাগ করা। ভবিষ্যতে না করার দৃঢ় প্রতিক্ষা করা।’[28]
ইমাম বাগভী (র) বলেন:
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, উবাই রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:[29]
التوبة النصوح أن يتوب، ثم لا يعود إلى الذنب كما لا يعود اللبن إلى الضرع.
‘তাওবায়ে নাসূহ হলো তাওবা করার পর গোনাহের দিকে প্রত্যাবর্তন না করা। যেমন দুধ স্তনের দিকে ফিরে আসে না’
যথাসময়ে তাওবা না করে মুমূর্ষু অবস্থায় তাওবা করলে তা কোনো কাজে আসবে না।
আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন:
﴿وَلَيۡسَتِ ٱلتَّوۡبَةُ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسَّئَِّاتِ حَتَّىٰٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ ٱلۡمَوۡتُ قَالَ إِنِّي تُبۡتُ ٱلۡـَٰٔنَ وَلَا ٱلَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمۡ كُفَّارٌۚ أُوْلَٰٓئِكَ أَعۡتَدۡنَا لَهُمۡ عَذَابًا أَلِيمٗا ١٨ ﴾ [النساء: ١٨]
‘তাওবা তাদের জন্য নয়, যারা আজীবন মন্দকাজ করে এবং তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হলে সে বলে, আমি এখন তাওবা করছি এবং তাওবা তাদের জন্যও নয়, যারা মারা যায় কাফির অবস্থায়। এরাই তারা, যাদের জন্য আমি মর্মন্তদ শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।’[30]
খালিস অন্তঃকরণে তাওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা তাওবা কবুল করেন এবং জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘তুমি যদি এত অধিক পরিমাণ পাপ কাজ করে থাক যে, তা আকাশ সমান উঁচু হয়, এরপর অনুতাপের সাথে ‘তাওবা’ কর, তবুও তোমার তাওবা কবুল হবে, প্রত্যাখ্যাত হবে না।[31]
এই উম্মতের প্রতি আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতসমূহের মধ্য থেকে একটি নেয়ামত এই যে, তিনি তওবার দরজা বন্ধ করেন নি। বরং জীবনের প্রতি মুহূর্তেই তওবার প্রতি মানুষকে উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে অন্তর্দৃষ্টি দান করেছেন তাকে সর্বদা সন্দেহাতীতভাবে তাওবার প্রতি গুরুত্ববহ থাকতে আদেশ করেছেন।
তওবার প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার উৎসাহ প্রদানের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, তিনি তওবাকারীর গোনাহগুলোকে নেকী দ্বারা রূপান্তর করে দেবেন।
আল্লাহ বলেন:
﴿ إِلَّا مَن تَابَ وَءَامَنَ وَعَمِلَ عَمَلٗا صَٰلِحٗا فَأُوْلَٰٓئِكَ يُبَدِّلُ ٱللَّهُ سَئَِّاتِهِمۡ حَسَنَٰتٖۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا﴾ [الفرقان: ٦٩]
“কিন্তু যারা তওবা করেছে এবং ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, এদের গোনাহগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা নেকী দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”[32]
অপর এক আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
﴿۞قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ ﴾ [الزمر: ٥٣]
“আপনি বলে দিন! আত্মার প্রতি যুলুমকারী আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহর নেয়ামত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সকল গোনাহ মোচনকারী। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।”[33]
এদিকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবা দ্বারা যারপরনাই আনন্দিত হন।
যেমনটি হাদীসে এসেছে: ‘খাদেমুন্নবী’ আবু হামযা আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«لله أفرح بتوبة عبده من أحدكم سقط على بعيره ، وقد أضله في أرض فلاة».
“আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবা দ্বারা অতখানি খুশী হন যতখানি খুশী হয় বিজন মরুতে হারিয়ে ফেলা উটের মালিক তার উট প্রাপ্তিতে।”[34]
কাজেই কোনও মুসলিম যখন গোনাহে লিপ্ত হয় তখন তার মাটিতে উট পাখির মত কপাল না ঠুকে আল্লাহর কাছে নিজের কৃত গোনাহর স্বীকৃতি দেয়া দরকার। অনুতপ্ত হওয়া দরকার। এর এ কথাটিও মনে রাখা দরকার যে, গোনাহকে তুচ্ছ করার দ্বারা গোনাহকারীর কোনও উপকার হয় না এবং তার গোনাহ সামান্য হালকাও হয় না বরং তা আরো বাড়তে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পবিত্র নামসমূহের অন্তত দু‘টি গুণবাচক নাম বান্দাহর গোনাহ মাফ করার বৈশিষ্ট্য হিসাবে বরাদ্দ রেখেছেন। তিনি বলেন,
﴿ أَلَمۡ يَعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ هُوَ يَقۡبَلُ ٱلتَّوۡبَةَ عَنۡ عِبَادِهِۦ ﴾ [التوبة: ١٠٤] .
“তারা কী জানে না, আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের তওবা গ্রহণ করে থাকেন।”[35]
আল্লাহ আরো বলেন:
﴿ وَأَنِيبُوٓاْ إِلَىٰ رَبِّكُمۡ وَأَسۡلِمُواْ لَهُۥ مِن قَبۡلِ أَن يَأۡتِيَكُمُ ٱلۡعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ ٥٤ ﴾ [الزمر: ٥٤]
“তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমুখী হও এবং তাঁর আজ্ঞাবহ হও তোমাদের কাছে আযাব আসার পূর্বে। এরপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না”[36]
আল্লাহর কাছে সাহায্য চাই তাঁর উচ্চ মহান নামাবলি ও সুস্থ-সুমহান গুণাবলীর বদৌলতে যে, তিনি যেন আমাদের তওবা কবুল করেন, আমৃত্যু এর উপর দৃঢ়পদ রাখেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও উত্তরদাতা।
ইমাম আহমদ প্রখ্যাত সাহাবী আবু সা‘ঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু- থেকে বর্ণনা করেন:
«إِنَّكُمْ لَتَعْمَلُونَ أَعْمَالًا لَهِيَ أَدَقُّ فِي أَعْيُنِكُمْ مِنَ الشَّعْرِ كُنَّا نَعُدُّهَا عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الْمُوبِقَاتِ».
“নিশ্চয় তোমরা অচিরেই এমন আমল করবে যা তোমাদের চোখে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম ও হালকা মনে হবে অথচ রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুগে আমরা একে ধ্বংসাত্মক মনে করতাম।”[37]
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা আমরা আজকালকার দিনের গোনাহকে হালকা অনুভব ও এর প্রতি বেপরোয়া মনোভাবের কথা অবগত হতে পারলাম। মানুষ গোনাহকে হালকা মনে করতে করতে এক সময় কবিরা গোনাহে লিপ্ত হয়ে যায়। এমনকি কেউ কেউ গোনাহের অনুভূতি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। একথা স্মরণযোগ্য যে, অনুতাপ হচ্ছে তওবার প্রধান অঙ্গ ও শর্ত। অনেক তওবাকারীর জীবনে এ দিকটির অনুপস্থিতি দেখা যায়। এমনিভাবে গোনাহের প্রতি এ ধরনের উদাসীনতা মানুষকে গোনাহের প্রতি আকর্ষিত ও অভ্যস্ত করে তোলে। এর থেকে তার পরিত্রাণের কোনও সুযোগ থাকে না; যদিও আল্লাহ তা‘আলা এর থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা রেখেছিলেন তওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে। সহীহ হাদীসে উল্লেখ আছে, গোনাহ লেখক বাম কাঁধের ফেরেশতা। বান্দার গোনাহ অন্তত গোনাহ করার পর থেকে ৬ ঘন্টা পর্যন্ত লেখা থেকে বিরত থাকে। এই ৬ ঘন্টার মধ্যে বান্দা যদি অনুতপ্ত হয় ও ইস্তেগফার করে তাহলে ওই গোনাহ মুছে দেন অন্যথা আমলনামায় গোনাহ লেখা হতে থাকে।[38]
মুসলিম উম্মাহর আলেমগণ তওবা ও ইস্তেগফারের আবশ্যকতার উপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন। ইমাম কুরতুবী (রহ) বলেন, মুসলিম উম্মাহ এ বিষয়ে একমত যে, মুমিন বান্দার উপর তওবা করা ফরয। কাজেই সকলের উপর এ ফরয বর্তাবে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
«مَا مِنْ عَبْدٍ مُؤْمِنٍ يُذْنِبُ ذَنْبًا فَيَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ الطُّهُورَ، ثُمَّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ فَيَسْتَغْفِرُ اللَّهَ إِلَّا غَفَرَ اللَّهُ لَهُ»
“কোনো বান্দা যখন গোনাহ করে, তারপর সুন্দররূপে উযু করে দু‘রাকাত সালাত পড়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দেন।”[39]
No comments: