গোছলের বয়ান
গোছলের বয়ান
১। মাসআলাঃ (গোছল করিবার পূর্বে প্রথম মনে মনে নিয়ত করিবে অর্থাৎ, চিন্তা করিবে যে, আমি পাক হইবার উদ্দেশ্যে গোছল করিতেছি!) তারপর প্রথমে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধুইবে, তারপর এস্তেঞ্জার জায়গা ধুইবে। হাতে এবং এস্তেঞ্জার জায়গায় নাজাছাত থাকুক বা না থাকুক, এই জায়গা প্রথমে ধুইবে। তারপর শরীরের কোথাও নাজাছাত লাগিয়া থাকিলে তাহা ধুইবে, তারপর ওযূ করিবে। যদি কোন চৌকি বা পাথরের উপর গোছল করে (যাহাতে পরে আর পা ধোয়ার দরকার হইবে না,) তবে ওযূ করার সঙ্গে সঙ্গেই পাও ধুইয়া লইবে, আর যদি এমন জায়গায় গোছল করে যে, পায়ে কাদা লাগিয়া যাইবে এবং পরে আবার ধুইতে হইবে, তবে পূর্ণ অযূ করিবে কিন্তু পা ধুইবে না। তৎপর তিনার মাথায় পানি ঢালিবে, তারপর তিনবার ডান কাঁধে পানি ঢালিবে, তারপর তিনবার বাম কাঁধে পানি ঢালিবে। পানি এমনভাবে ঢালিবে যাহাতে সমস্ত শরীর ধুইয়া যায়। তারপর পাক জায়গায় সরিয়া গিয়া পা ধুইয়া লইবে, আর যদি ওযূর সঙ্গে পা ধুইয়া থাকে, তবে আবার ধোয়ার দরকার নাই। ━শরহে তানবীর
২। মাসআলাঃ পানি ঢালিবার পূর্বে সমস্ত শরীর ভালমতে ভিজা হাত দ্বারা মুছিয়া দিবে, তারপর পানি ঢালিবে। এইরূপ করিলে সহজে সমস্ত জায়গায় পানি পৌঁছিয়া যাইবে, কোথাও শুকনা থাকিবে না। ━মুনইয়া
৩। মাসআলাঃ উপরে গোছলের যে নিয়ম বলা হইয়াছে ইহাই সুন্নত মোতাবেক গোছল। কিন্তু ইহার মধ্যে কয়েকটি কাজ এমন আছে যাহা না হইলে গোছলই হয় না; যেমন নাপাক তেমন নাপাকই থাকিবে, সেগুলিকে ফরয বলে। আর কতকগুলি কাজ এমন আছে যাহা করিলে সওয়াব পাওয়া যায়, কিন্তু না করিলে গোছল হইয়া যায়, এইগুলিকে সুন্নত বলে। গোছলের মধ্যে ফরয মাত্র তিনটি; যথা━ (১) এমনভাবে কুলি করা যাহাতে সমস্ত মুখে পানি পৌঁছিয়া যায়; (২) নাকের নরম স্থান পর্যন্ত পানি পৌঁছান; (৩) সমস্ত শরীরে পানি পৌঁছান। ━হেদায়া
৪। মাসআলাঃ গোছলের সময় কেবলার দিকে মুখ করিবে না। পানি বেহুদা খরচ করিবে না, আবার এত কমও খরচ করিবে না যে, গোছলও ভালমতে হয় না। গোছল এমন জায়গায় করিবে যেন অন্য কেহ দেখিতে না পায়। গোছল করিবার সময় কথা বলিবে না। গোছল শেষ হইলে কাপড় দ্বারা শরীর মুছিয়া ফেলিয়া (মেয়েলোক) অতি সত্বর শরীর ঢাকিয়া লইবে। এমন কি, যদি গোছলের ওযূ করিবার সময় পা না ধুইয়া থাকে, তবে গোছলের জায়গা হইতে সরিয়া আগে শরীর ঢাকিয়া লইবে পরে উভয় পা ধুইবে। ━মারাকী
৫। মাসআলাঃ কাহারও দেখিবার সম্ভাবনা নাই এ-রকম জায়গায় উলঙ্গ হইয়া গোছল করাও জায়েয আছে বসিয়া হোক অথবা দাঁড়াইয়া, গোছলখানার ছাদ থাকুক বা না থাকুক; কিন্তু (এরকম দরকার পড়িলে) বসিয়া গোছল করাই বেহরত (উত্তম)। কেননা, বসিয়া গোছল করাতে পর্দা বেশী হয়; নাভি হইতে হাঁটু পর্যন্ত স্ত্রীলোকের জন্যও অপর স্ত্রীলোকের সামনে খোলা জায়েয নহে। সাধারণতঃ মেয়েলোকেরা এদিকে লক্ষ্য রাখে না। তাহারা ভাবে যে, আওরাতের সামনে আওরাতের আর কি পর্দা, কিন্তু ইহা মস্ত বড় ভুল এবং নির্লজ্জতার কথা। ━মারাকী
৬। মাসআলাঃ গোছল করিবার নিয়ত করুক বা না করুক, সমস্ত শরীরে পানি বহিয়া গেলে এবং কুলি করিয়া লইলে, আর নাকে পানি দিলে গোছল হইয়া যাইবে। এরূপ শরীর ঠাণ্ডা করিবার উদ্দেশ্যে বৃষ্টিতে যদি দাঁড়ায় বা হঠাৎ পুকুর ইত্যাদিতে পড়িয়া যায় আর সমস্ত শরীর ভিজিয়া যায়, কুলিও করিয়া লয় এবং নাকেও পানি দিয়া লয়, তবে গোছল হইয়া যাইবে। গোছল করিবার সময় কলেমা পড়া বা কলেমা পড়িয়া পানিতে ফুঁক দিয়া লওয়ারও কোন দরকার নাই; কলেমা পড়ুক বা না পড়ুক গোছল হইয়া যাইবে, বরং গোছল করিবার সময় কলেমা বা অন্য কোন দোআ না পড়াই ভাল। ━মুনইয়া
৭। মাসআলাঃ সমস্ত শরীরের একটা পশম পরিমাণ শুকনা থাকিলেও গোছল হইবে না। এইরূপে যদি কুলি করিতে বা নাকে পানি দিতে ভুলিয়া গিয়া থাকে, তবেও গোছল হইবে না। (যেমন নাপাক ছিল তেমই থাকিবে, নামায ইত্যাদি কিছুই হইবে না। ━মুনইয়া
৮। মাসআলাঃ গোছল শেষে মনে পড়িল যে, অমুক জায়গাটা শুকনা রহিয়া গিয়াছে, এমতাবস্থায় আবার সম্পূর্ণ গোছল দোহরাইবার দরকার নাই, শুধু সেই জায়গাটুকু ধুইয়া লইলেই হইবে; কিন্তু শুধু ভিজা হাত ফিরাইয়া দিলে হইবে না, কিছু পানি লইয়া ধুইয়া ফেলিবে। আর যদি কুলি করিতে ভুলিয়া গিয়া থাকে, তবে এখন শুধু কুলি করিবে; আর যদি নাকে পানি দেওয়া ভুলিয়া থাকে, এখন শুধু নাকে পানি দিবে। ফলকথা, যেটুকু বাকী রহিয়াছে শুধু সেইটুকু ধুইলেই চলিবে; সম্পূর্ণ গোছল দোহরাইতে হইবে না। ━মুনইয়া
৯। মাসআলাঃ রোগের দরুন মাথায় পানি দিলে যদি ক্ষতি হয়, তবে মাথা ব্যতীত সমস্ত শরীর ধুইয়া লইলেও গোছল হইয়া যাইবে। সুস্থ হওয়ার পর মাথা ধুইলে চলিবে। সম্পূর্ণ গোছল দোহরাইতে হইবে না। ━শরহে তানবীর
১০। মাসআলাঃ গোছলের মাসায়েল দ্রষ্টব্য।
১১। মাসআলাঃ যদি মেয়েলোকের মাথায় চুল বেণী পাকান না হয়, তবে সমস্ত চুল এবং চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছান ফরয। যদি একটি চুল বা একটি চুলের গোড়াও শুকনা থাকে, তবে গোছল হইবে না। যদি চুল বেণী পাকান হয়, তবে সমস্ত চুল না ভিজাইলেও চলিবে। অবশ্য চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছান ফরয। একটি চুলের গোড়াও শুকনা থাকিলে চলিবে না। যদি বেণী না খুলিয়া সমস্ত চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছান সম্ভব না হয়, তবে বেণী খুলিয়া ফেলিতে হইবে এবং সমস্ত চুলও ভিজাইতে হইবে। (পুরুষের বেণী থাকিলে তাহার বেণী খুলিয়া সমস্ত চুল ভিজাইতে হইবে।)১
১২। মাসআলাঃ নথ, আংটি বালি, কানফুল, নাকফুল ইত্যাদি ভালমতে নাড়িয়া ছিদ্রের ভিতরে পানি প্রবেশ করাইয়া দিবে, আর যদি বালি ইত্যাদি না-ও থাকে, তবুও সতর্কতার সহিত ছিদ্রগুলির মধ্যে পানি পৌঁছাইয়া দিবে। কেননা, অসতর্কতাহেতু কোনও স্থান শুকনা থাকিলে গোছল হইবে না। যদি আংটি ইত্যাদি খুব ঢিলা হয় যাহাতে অনায়াসে পানি পৌঁছিতে পারে, তবে নাড়িয়া চাড়িয়া পানি দেওয়া ওয়াজেব নহে; বরং মোস্তাহাব। ━মুনইয়া
১৩। মাসআলাঃ নখের মধ্যে (বা অন্য কোথাও) কিছু আটা, চুন ইত্যাদি লাগিয়া শুকাইয়া থাকার কারণে উহাতে পানি না পৌঁছিলে গোছল হইবে না। স্মরণ হইলে এবং দেখা মাত্র উহা বাহির করিয়া কিছু পানি দ্বারা ঐ জায়গাটুকু ভিজাইয়া দিবে। আর এই ভিজাইবার পূর্বে যদি কোন নামায পড়িয়া থাকে, তবে তাহা দোহরাইতে হইবে। ━ শামী
১৪। মাসআলাঃ হাত বা পা ফাটিয়া যাওয়ায় যেখানে (আমের আঠা) মোম, তৈল বা অন্য কোন ঔষধ ভরিয়া দেওয়া হইয়াছে সেখানে ঔষধের উপর দিয়া পানি বহাইয়া দিলেই গোছল দুরুস্ত হইবে। ━মুনইয়া
১৫। মাসআলাঃ কান এবং নাভিতেও খুব খেয়াল করিয়া পানি পৌঁছাইবে, কারণ উহাতে পানি না পৌঁছিলে গোছল হইবে না। ━শরহে তানবীর
১৬। মাসআলাঃ গোছল করিবার সময় কেহ কুলি করে নাই, কিন্তু মুখ ভরিয়া পানি খাইয়াছে এবং সমস্ত মুখে পানি লাগিয়াছে, তবে তাহার গোছল হইয়া যাইবে। কেননা, সমস্ত মুখের মধ্যে পানি পৌঁছান মকছুদ, চাই কুলি করুক বা না করুক। কিন্তু যদি এমনভাবে পানি পান করে যে, সমস্ত মুখে পানি লাগে নাই, তবে অবশ্য কুলি করিতে হইবে, এরূপ পানি পানে কুলির কাজ হইবে না। ━মুনইয়া
১৭। মাসআলাঃ চুলে বা হাতে-পায়ে এমনভাবে তৈল লাগান আছে যে, শরীরে পানি ভালরূপে দাঁড়াইতে পারে না, তবে তাহাতেও কোন ক্ষতি নাই। শরীরের সব জায়গায় ও মাথায় পানি ঢালিয়া দিলে গোছল হইয়া যাইবে।
১৮। মাসআলাঃ সুপারি বা অন্য কিছু দাঁতের ফাঁকে ঢুকিয়া থাকিলে খেলাল দিয়া তাহা বাহির করিয়া ফেলিবে, কেননা উহার কারণে যদি দাঁতের গোড়ায় পানি না পৌঁছে, তবে গোছল হইবে না। ━মুনইয়া
১৯। মাসআলাঃ মাথায় যদি আফশান লাগাইয়া থাকে, বা চুলে এমন আঠা লাগিয়াছে যে চুল ভালরূপে ভিজে না, তবে তাহা ছাড়াইয়া ফেলিয়া, চামড়া পর্যন্ত পানি পৌঁছাইবে; শুধু উপরে পানি বহাইলে গোছল হইবে না। ━মুনইয়া
২০। মাসআলাঃ দাঁতে যদি মিসি জমাইয়া থাকে তাহা ছাড়াইয়া ফেলিয়া কুলি করিবে, নতুবা গোছল হইবে না। ━মুনইয়া
২১। মাসআলাঃ চোখের পিচুটি যদি এমনভাবে জমিয়া গিয়া থাকে যে, তাহা উঠাইয়া না ফেলিলে নীচে পানি পৌঁছিবে না, তবে উহা উঠাইয়া ফেলিয়া নীচ পর্যন্ত পানি পৌঁছাইতে হইবে। নচেৎ ওযূ-গোছল কিছুই শুদ্ধ হইবে না। ━মুনইয়া
গোছল ফরয হইবার কারণসমূহ পরে লিখা হইয়াছে।
No comments: