Breaking News
recent

১০৫ সূরা আল ফীল অর্থ ও তাফসীর

সূরা আল ফীল
Sura Al fil
১০৫ সূরা আল ফীল অর্থ ও তাফসীর online24.bd 

﴿بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ﴾
১) তুমি কি দেখনি  তোমার রব হাতিওয়ালাদের সাথে কি করেছেন? 
১. বাহ্যত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু মূলত এখানে শুধূ কুরাইশদেরকেই নয় বরং সমগ্র আরববাসীকেই সম্বোধন করা হয়েছে৷ তারা এই সমগ্র ঘটনা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত ছিল৷ কুরআন মজীদের বহু স্থানে ' আলাম তারা ' ( তুমি কি দেখনি ?) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ৷ এর মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নয় বরং সাধারণ লোকদেরকে সম্বোধন করাই উদ্দেশ্য৷ উদাহরণ স্বরূপ নিম্নোক্ত আয়াতগুলো দেখুন : ইবরাহীম ১৯ আয়াত , আল হাজ্জ ১৮ ও ৬৫ আয়াত , আন নূর ৪৩ আয়াত , লোকমান ২৯ ও ৩১ আয়াত , ফাতের ২৭ আয়াত এবং আয যুমার ২১ আয়াত ) তাছাড়া দেখা শব্দটি এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে , মক্কায় ও তার আশে পাশে এবং আরবের বিস্তৃত এলাকায় এ আসাহাবে ফীলের ঘটনাটি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছে এ ধরনের বহু লোক সে সময় জীবিত ছিল৷ কারণ তখনো এই ঘটনার পর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হয়ে যায়নি৷ লোক মুখে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ সরাসরি এত বেশী বেশী সূত্রে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল যার ফলে এটা প্রায় সব লোকেরই চোখে দেখা ঘটনার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল৷
২. এই হাতিওয়ালা কারা ছিল, কোথায় থেকে এসেছিল , কি উদ্দেশ্যে এসেছিল এসব কথা আল্লাহ এখানে বলছেন না৷ কারণ এগুলো সবাই জানতো ৷ 
﴿أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ﴾
২) তিনি কি তাদের কৌশল  ব্যর্থ করে দেননি ? 
৩. মূলে কাইদা ( আরবী ---------) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ কোন ব্যক্তিকে ক্ষতি করবার জন্য গোপন কৌশল অর্থে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়৷ প্রশ্ন হচ্ছে , এখানে গোপন কি ছিল ? ষাট হাজার লোকের একটি সেনাবাহিনী কয়েকটি হাতি নিয়ে প্রকাশ্যে ইয়ামন থেকে মক্কায় আসে ৷ তারা যে কা'বা শরীফ ভেঙ্গে ফেলতে এসেছে , একথাও তারা গোপন করেনি৷ কাজেই এ কৌশলটি গোপন ছিল না৷ তবে হাবশীরা কা'বা ভেঙ্গে ফেলে কুরাইশদেরকে বিধ্বস্ত করে এবং এভাবে সমগ্র আরববাসীদেরকে ভীত ও সন্ত্রন্ত করে দক্ষিণ আরব থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথ আরবদের কাছে থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছিল৷ এটা ছিল তাদের মক্কা আক্রমণের উদ্দেশ্য৷ এ উদ্দেশ্যটিকে তারা গোপন করে রাখে৷ অন্যদিকে তারা প্রকাশ করতে থাকে কয়েকজন আরব তাদের গীর্জার যে অবমাননা করেছে , কা'বা শরীফ ভেঙে ফেলে তার তার প্রতিশোধ নিতে চায়৷ 
৪. মূলে বলা হয়েছে ( আরবী ----------------------) অর্থাৎ তাদের কৌশলকে তিনি ভ্রষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন৷ কিন্তু প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী কৌশলকে ভ্রষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করার মানে হয় তাকে নষ্ট ও বিধ্বস্ত করে দেয়া অথবা নিজের উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে তাকে ব্যর্থ করে দেয়৷ যেমন আমরা বলি , অমুক ব্যক্তির তীর লক্ষ ভ্রষ্ট হয়েছে , তার সবচ প্রচেষ্টা ও কলাকৌশল ব্যর্থ হয়েছে৷ কুরআন মজীদের এক জায়াগায় বলা হয়েছে ( আরবী --------------) " কিন্তু কাফেরদের কলা কৌশল ব্যর্থ হয়েছে৷ ( আল মু'মিন ২৫ ) অন্য জায়গায় বলা হয়েছে : ( আরবী --------------------) " আর আল্লাহ খেয়ানতকারীদের কৌশলকে সফলতার দ্বারে পৌঁছিয়ে দেন না৷ " ( ইউসূফ ৫২) আরববাসীরা ইমরাউল কায়েসকে ( আরবী -------------) " বিনষ্টকারী বাদশাহ " বলতো ৷ কারণ সে তার বাপের কাছ থেকে পাওয়া বাদশাহী হারিয়ে ফেলেছিল৷
﴿وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ﴾
৩) আর তাদের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠান , 
৫. মূলে বলা হয়েছে ( আরবী ---------------) আরবীতে আবাবীল মানে হচ্ছে , বহু ও বিভিন্ন দল যারা একের পর এক বিভিন্ন দিক থেকে আসে৷ তারা মানুষও হতে পারে আবার পশু হতে পারে ৷ ইকরামা ও কাতাদাহ বলেন , লোহিত সাগরের দিক থেকে এ পাখিরা দলে দলে আসে ৷ সাঈদ ইবনে জুবাইর ও ইকরামা বলেন , এ ধরনের পাখি এর আগে কখনো দেখা যায়নি এবং এর পরেও দেখা যায়নি৷ এগুলো নজদ , হেজায , তেহামা বা লোহিত সাগরের মধ্যবর্তী উপকূলে এলাকার পাখি ছিল না৷ ইবনে আব্বাস বলেন , তাদের চঞ্জু ছিল পাখিদের মতো এবং পাঞ্জা কুকুরের মতো৷ ইকরামার বর্ণনা মতে তাদের মাথা ছিল শিকারী পাখীর মাথার মত৷ প্রায় সকল বর্ণনাকারীর সর্বসম্মত বর্ণনা হচ্ছে , প্রত্যেকটি পাখির ঠোঁটে ছিল একটি করে পাথরে কুচি এবং পায়ে ছিল দু'টি করে পাথরের কুচি৷ মক্কার অনেক লোকের কাছে এই পাথর দীর্ঘকাল পর্যন্ত সংরক্ষিত ছিল৷ আবু নু'আইম নওফাল ইবনে আবী মু' আবীয়ার বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন৷ তিনি বলেছেন , আসহাবে ফীলের ওপর যে পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছিল আমি তা দেখেছি৷ সেগুলোর এক একটি ছিল ছোট মটর দানার সমান৷ গায়ের রং ছিল লাল কালচে৷ আবু নু'আইম ইবনে আব্বাসের যে রেওয়ায়াত উদ্ধুত করেছেন তাতে বলা হয়েছে , সেগুলো ছিল চিলগুজার * সমান৷ অন্যদিকে ইবনে মারদুইয়ার বর্ণনা মতে , সেগুলো ছিল ছাগলের লেদীর সমান৷ মোটকথা , এসবগুলো পাথর সমান মাপের ছিল না ৷ অবশ্যি কিছু না কিছু পার্থক্য ছিল৷

* চিলগুজা চীনাবাদাম জাতীয় এক ধরনের শুকনা ফল৷ লম্বায় ও চওড়ায় একটি চীনাবাদামের প্রায় সমান৷
﴿تَرْمِيهِم بِحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ﴾
৪) যারা তাদের ওপর নিক্ষেপ করছিল পোড়া মাটির পাথর৷ 
৬. মূল শব্দগুলো হচ্ছে , ( আরবী -----------------) অর্থাৎ সিজজীল ধরনের পাথর৷ ইবনে আব্বাস বলেন , এ শব্দটি মূলত ফারসীর " সংগ" ও " গীল " শব্দ দু'টির আরবী করণ৷ * এর অর্থ এমন পাথর যা কাদা মাটি থেকে তৈরি এবং তাকে আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করা হয়েছে ৷ কুরআন মজীদ থেকে ও এই অর্থের সত্যতা প্রমাণ হয়৷ সূরা হূদের ৮২ ও সূরা হুজুরাতের ৪ আয়াতে বলা হয়েছে , লূত জাতির ওপর সিজজীল ধরনের পাথর বর্ষণ করা হয়েছিল এবং এই পাথর সম্পর্কে সূরা যারিয়াতের ৩৩ আয়াতে বলা হয়েছে , সেগুলো ছিল মাটির পাথর অর্থাৎ কাদামাটি থেকে সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল৷

মাওলানা হামীদুদ্দিন ফারাহী মরহুম ও মগফুর বর্তমান যুগে কুরআনের অর্থ বর্ণনা ও গভীর তত্ত্ব অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন৷ তিনি এ আয়াতে " তারমীহিম " ( তাদের ওপর নিক্ষেপ করছিল) শব্দের কর্তা হিসেবে মক্কাবাসী ও অন্যান্য আরববাসীদেরকে চিহ্নিত করেছেন৷ " আলাম তারা " ( তুমি কি দেখনি ) বাক্যাংশেও তাঁর মতে এদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে৷ পাখিদের সম্পর্কে তিনি বলেন , তারা পাথর নিক্ষেপ করছিল না বরং তারা এসেছিল আসহাবে ফীলের লাশগুলি খেয়ে ফেলতে৷ এই ব্যাখ্যার সপক্ষে তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন তার নির্যাস হচ্ছে এই যে , আবদুল মুত্তালিবের আবরাহার কাছে গিয়ে কা'বার পরিবর্তে নিজে উট ফেরত নেবার জন্য দাবী জানানোর ব্যাপারটি কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না৷ অন্য দিকে কুরাইশরা এবং অন্যান্য যেসব লোকেরা হজ্জের জন্য এসেছিল তারা হানাদার সেনাদলের কোন মোকাবেলা না করে কাবাঘরকে তাদের করুণা ও মেহেরবানির ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা পাহাড়ের ওপর গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করবে , একথাও দুর্বোধ্য মনে হয়৷ তাই তাঁর মতে আসল ঘটনা হচ্ছে , আরবরা আবরাহার সেনাদলের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে এবং আল্লাহ পাথর বর্ষণকারী ঝড়ো বাতাস প্রবাহিত করে এই সেনাদলকে বিধ্বস্ত করেন৷ তারপর তাদের লাশ খেয়ে ফেলার জন্য পাখি পাঠান ৷ কিন্তু ভূমিকায় আমরা বলেছি , আবদুল মুত্তালিব তার উট দাবী করতে গিয়েছিলেন , রেওয়ায়াতে কেবল একথাই বলা হয়নি৷ বরং রেওয়ায়াতে একথাও বলা হয়েছে যে , আবদুল মুত্তালিব তাঁর উটের দাবীই জানাননি এবং আবরাহাকে তিনি কাবা আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টাও করেছিলেন ৷ আমরা একথাও বলেছি , সমস্ত নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত অনুযায়ী আবরাহা মহররম মাসে এসেছিল৷ তখন হাজীরা ফিরে যাচ্ছিল আর একথাও আমরা জানিয়ে দিয়েছি যে , ৬০ হাজার সৈন্যের মোকাবেলা করা কুরাইশদের ও তাদের আশেপাশের গোত্রগুলোর সামর্থের বাইরে ছিল৷ আহযাব যুদ্ধের সময় বিরাট ঢাক ঢোল পিটিয়ে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে আরব মুশরিক ও ইহুদি গোত্রগুলোর যে সেনাদল তার এনেছিল তার সংখ্যা দশ বারো হাজারের বেশী ছিল না৷ কাজেই ৬০ হাজার সৈন্যের মোকাবেলা করার সাহস তারা কেমন করে করতে পারতো ? তবুও এ সমস্ত যুক্তি বাদ দিয়ে যদি শুধু মাত্র সূরা ফীলের বাক্য বিন্যাসের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যায় তাহলে এ ব্যাখ্যা তার বিরোধী প্রমাণিত হয়৷ আরবরা পাথর মারে এবং তাতে আসহাবে ফীল মরে ছাতু হয়ে যায় আর তারপর পাখিরা আসে তাদের লাশ খাবার জন্য , ঘটনা যদি এমনি ধরা হতো তাহলে বাক্য বিন্যাস হতো নিম্নরূপভাবে :
আরবী ----------------------------------------------------------------------------------
( তোমরা তাদেরকে মারছিলে পোড়া মাটির পাথর ৷ তারপর আল্লাহ তাদেরকে করে দিলেন ভুক্ত ভূষির মতো৷ আর আল্লাহ তাদের উপর ঝাঁকে ঝঁকে পাখি পাঠালেন ) কিন্তু এখানে আমরা দেখছি , প্রথমে আল্লাহ পাখির ঝাঁক পাঠাবার কথা জানালেন তারপর তার সাথে সাথেই বললেন : ( আরবী -----------------------) অর্থাৎ যারা তাদেরকে পোড়া মাটির তৈরী পাথরের কুচি দিয়ে মারছিল৷ সবশেষে বললেন , তারপর আল্লাহ তাদেরকে ভুক্ত ভুষির মতো করে দিলেন৷
* সংগ মানে পাথর এবং গীল মানে কাদা ৷ - অনুবাদক
﴿فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ﴾
৫) তারপর তাদের অবস্থা করে দেন পশুর খাওয়া ভূষির মতো৷ 
৭. আসল শব্দ হচ্ছে , ( আরবী ---------------------------) আসফ শব্দ সূরা আর রহমানের ১২ আয়াতে এসেছে : (আরবী -------------------------) " শস্য ভূষি ও চারাওয়ালা ৷" এ থেকে জানা যায় , আসফ মানে হচ্ছে খোসা , যা শস্য দানার গায়ে লাগানো থাকে এবং কৃষক শস্য দানা বের করে নেবার পর যাকে ফেলে দেয় তারপর পশু তা খেয়ে ও ফেলে৷ আবার পশুর চিবানোর সময় কিছু পড়েও যায় এবং তার পায়ের তলায় কিছু পিশেও যায়৷ 
Website:bokulsrabon.blogspot.com 

No comments:

Powered by Blogger.