আবু বকর (রাঃ) এর কিছু ঘটনা
আবু বকর (রাঃ) এর কিছু ঘটনা
ঘটনা ১
আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর এই ঘটনাটি মোটামুটি আমরা সবাই জানি, কিন্তু ঘটনাটির মাঝে একটি গুরত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যা আমাদের অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে। ইনশাল্লাহ, সেই বিষয়েই এখানে আলোকপাত করব।
আহমদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত, জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রা) এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। রাসূল ﷺ মিরাজ থেকে ফিরে এসেছেন। সকালবেলা তিনি যখন মক্কার কুরাইশদের মিরাজের ঘটনাটি বললেন তখন কুফ্ফার সম্প্রদায় হাসি-তামাশায় লিপ্ত হয়েছিল। মক্কার এই কুরাইশ সম্প্রদায়ের কুফ্ফারগণ ছিলেন অনেকটা বস্তুবাদি। যা দেখা, যায় ধরা যায়, ছোয়া যায় শুধু তাই তারা আমলে নিত। রাসূল ﷺ এর মিরাজের ঘটনাটিকে তারা একটা হাতিয়ার হিসেবে ধরে নিল আর এর মাধ্যমে মিরাজের ঘটনাটিকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চাইল। কুফ্ফার সম্প্রদায়ের কিছু লোক আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর নিকট গেলেন। তিনি বাণিজ্য থেকে কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছেন, তাই তখনও রাসূল ﷺ এর সাথে দেখা করতে পারেননি। কুফ্ফার সম্প্রদায় তাকে বলল, শুনেছ কি তোমার সঙ্গী কি সব বলা শুরু করেছে? সে বলছে, সে নাকি এক রাতের মধ্যে মক্কা থেকে বাইতুল মাকদাস(জেরুজালেম) যেয়ে আবার মক্কায় ফিরে এসেছে। আবু বকর (রা) বললেন, এই কথাগুলো কি তিনি বলেছেন? তারা জবাব দিল, হ্যাঁ। এরপর আবু বকর (রা) বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, যদি তিনি সত্যিই বলে থাকেন, তাহলে তিনি সত্য বলেছেন। কুফফার সম্প্রদায়ের বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠে গেল। তারা বলল, তুমি বিশ্বাস কর সে বৃহত্তর সিরিয়ায় যেয়ে আবার এক রাতের মধ্যে ফিরে এসেছে! আবু বকর (রা) বললেন, আমি তাকে বিশ্বাস করি বরং এর চেয়েও বেশী বিশ্বাস করি ঐসব বিষয়ে যেগুলো তাঁর নিকট ওহী হিসেবে এসেছে। মোটামুটি এই ঘটনাটুকু আমরা সবাই জানি, কোন বইতে পড়ে কিংবা কারো নিকট থেকে এই ঘটনা শুনে আমরা পুলকিত হই কিন্তু এই ঘটনার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ একটি হিকমা রয়েছে যা আমাদের অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে।
কুফ্ফার সম্প্রদায় যখন আবু বকর (রা) কে রাসূল ﷺ এর মিরাজ সম্পর্কিত কথাটি বলল তখন, আবু বকর (রা) এর যদি দূর্বল ঈমান থাকত তাহলে তিনি বলতেন, না এই ঘটনাটি সত্য নয় অথবা, আবু বকর (রা) যদি এমন হতেন যাকে খুব সহজেই কথার চাতুরী দ্বারা অভিভূত করা যায় তাহলে তিনি বলতেন ঘটনাটি সত্য। আবু বকর (রা) চমৎকারভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, মাশাল্লাহ। তিনি ঘটনাটি শুনেছেন কুফ্ফারদের নিকট থেকে আর তাই আবু বকর (রা) বললেন, যদি তিনি সত্যিই বলে থাকেন, তাহলে তিনি সত্য বলেছেন।
এর দুইটি অংশ রয়েছে, প্রথমত, ‘যদি তিনি সত্যিই বলে থাকেন’ – হাদীস বিশেষজ্ঞগণ এই পদ্ধতীতে কাজ করেন, অর্থাৎ যদি উৎস সত্যিই রাসূল ﷺ এর নিকট থেকে আসে- দ্বিতীয়ত, তাহলে তা সত্য। সেটা হচ্ছে ওহী, আল্লাহর নিকট থেকে রাসূল ﷺ এর উপর নাযিলকৃত। অর্থাৎ সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, সেই অনুযায়ী কর্তব্য পালন করা ঈমানী দায়িত্ব, কারণ সেটা ওহী। এমন কথা বলা যাবে না যে, এটা তো আমার যুক্তিতে টিকল না বা আমার বাপ-দাদাদের কখনও এমন কিছু বলতে বা করতে দেখিনি কিংবা আমার মাযহাবে এমনটি সমর্থন করে না’।
আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর এই ঘটনা থেকে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এটাই, রাসূল ﷺ এর কথা সহীহভাবে আমাদের নিকট পৌছালে বিনা বাক্য ব্যয়ে তা মেনে নিতে হবে, তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কর্ম পালন করতে হবে। সেটা আমার নিকট যুক্তিতে টিকুক আর না টিকুক, আমার চারপাশে লোকজন সেটা মানুক আর না মানুক আমাকে রাসূল ﷺ এর কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতেই হবে এবং তার যথাসাধ্য অনুসরণ করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের রাসূল ﷺ এর সাহাবীদের মতো করে দ্বীন ইসলামকে বুঝার তৌফিক দান করুন এবং সেই অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।
ঘটনা ২
রাবীয়া আসলামী (রাঃ) বলেন, একবার হযরত আবু বকর (রাঃ) ও আমার মধ্যে কোন বিষয়ে মত-পার্থক্য দেখা দিলে কিছু তর্ক-বিতর্কে তিনি কটু কথা বললে আমি আন্তরিকভাবেই ব্যথিত হলাম। তিনি সাথে সাথেই তা উপলব্ধি করে আমাকে বললেন, তুমিও আমাকে অনুরুপ কথা বলে প্রতিশোধ নাও। আমি এরুপ প্রতিশোধ নিতে অস্বীকার করলে তিনি বললেন, আমি রাসুল (সাঃ) এর দরবারে গিয়ে নালিশ করব। আমি তাতে অস্বীকৃতি জানালাম। তিনি চলে গেলেন। এমন সময় বনী আসলামের লোকজন এসে বলল, এ কেমন কথা; তিনিই অন্যায় করে আবার তিনিই রাসুল (সাঃ) এর কাছে নালিশ করতে গেলেন। আমি বললাম, ইনি আবু বরক সিদ্দীক (রাঃ)। তিনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হলে আমার ধ্বংস অনিবার্য।
এরপর রাসুল (সাঃ) এর খিদমতে আমি হাযির হয়ে পুরো ঘটনা বর্ননা করলে তিনি (সাঃ) বললেন, তুমি ঠিকই করেছ। কখনো প্রতিশোধমূলক উত্তর দেওয়া উচিত নয়। তবে এভাবে বলে দাও, হে আবু বকর! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। সত্যিকার আল্লাহভীতি একেই বলে। একটা কথার জন্য এত চিন্তা। আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর মত লোক হঠাৎ একটি মাত্র কটু কথা বলে একজনের মনে কষ্ট দিয়েছেন। কিন্তু এ কথার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তার কত চিন্তা, কত চেষ্টা। প্রথমে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন, প্রতিশোধ না নিলে তার বিরুদ্ধে রাসুল (সাঃ) এর নিকট নালিশ করবেন এই ধরনের কথা বললেন অর্থাৎ যে করেই হোক নিজের ত্রুটির জন্য আল্লাহর বান্দা থেকে ক্ষমা লাভ করতে হবে।
ঘটনা ৩
তাবুক অভিযানে তিনি ছিলেন মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী।এ অভিযানের সময় রাসুলাল্লাহ (সা),র এর আহবানে সাড়া দিয়ে বাড়িতে যা কিছু অর্থ-সম্পদ ছিল সবই তিনি রাসুলাল্লাহ (সা),র হাতে তুলে দেন। আল্লাহ’র রাসুল জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আবু বকর ছেলে মেয়েদের জন্য বাড়িতে কিছু রেখেছো কি ? জবাবে আবু বকর বললেনঃ তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই যথেষ্ট।
ঘটনা ৪
শৈশব থেকে আবু বকরের সাথে রাসুলাল্লাহ (সা)’র বন্ধুত্য ছিল। তিনি রাসুলাল্লাহ (সা)’র অধিকাংশ বাণিজ্য সফরের সফর সঙ্গী ছিলেন। একবার রাসুলাল্লাহ (সা)’র সঙ্গে ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়া যান। তখন তাঁর বয়স প্রায় আঠার আর হুজুর (সা) এর বয়স বিশ। তাঁরা যখন সিরিয়া সীমান্তে; বিশ্রামের জন্য রাসুলাল্লাহ (সা)’র একটি গাছের নীচে বসেন। আবু বকর একটু সামনে এগিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। এক খ্রীষ্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর দেখা হয় এবং ধর্ম বিষয়ে কিছু কথা-বার্তা হয়। আলাপের মাঝখানে পাদ্রী জিজ্ঞেস করে ওখানে গাছের নীচে কে ? আবু বকর বললেন, এক কুরাইশ যুবক, নাম মুহাম্মাদ বিন আবদিল্লাহ। পাদ্রী বলে উঠল, এ ব্যক্তি আরবদের নবী হবেন। কথাটি আবু বকরের অন্তরে গেথে যায়। তখন থেকেই তার অন্তরে রাসুলাল্লাহ (সা)’র নবী হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয় হতে থাকে। ইতিহাসে এ পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বা’ নাসতুরা’ বলে উল্লেখিত হয়েছে।
ঘটনা ৫
আবূদ্দারদা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সাঃ)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় আবূ বকর (রা:) পরনের কাপড়ের একপাশ এমনভাবে ধরে আসলেন যে, তার দুহাঁটু বেরিয়ে পড়ছিল। নবী (সাঃ) বললেন, তোমাদের এ সাথী এই মাত্র কারো সঙ্গে ঝগড়া করে আসছে। তিনি সালাম করলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমার এবং ওমর ইবনুল খাত্তাবের মাঝে একটি বিষয়ে কিছু কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। আমিই প্রথমে কটু কথা বলেছি।অতঃপর লজ্জিত হয়ে তার কাছে মাফ চেয়েছি। কিন্তু তিনি আমাকে মাফ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।এখন আমি আপনার নিকট হাযির হয়েছি। নবী (সাঃ) বললেন, আল্লাহ্ তোমাকে মাফ করবেন, হে আবূ বকর! এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন। অতঃপর ওমর (রা:) লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে আবূ বকর (রা:)-এর বাড়িতে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আবূ বকর কি বাড়িতে আছেন? তারা বলল, না। তখন ওমর (রা:) নবী (সাঃ)-এর নিকট চলে এসে সালাম দিলেন। (তাকে দেখে) নবী (সাঃ)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আবূ বকর (রা:) ভীত হয়ে নতজানু হয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমিই প্রথমে অন্যায় করেছি। এ কথাটি তিনি দুবার বললেন। তখন নবী (সাঃ) বললেন, আল্লাহ্ যখন আমাকে তোমাদের নিকট রাসূলরূপে প্রেরণ করেছেন তখন তোমরা সবাই বলেছ, তুমি মিথ্যা বলছ আর আবূ বকর বলেছে, আপনি সত্য বলেছেন। তাঁর জান-মাল সবকিছু দিয়ে আমাকে সহানুভূতি জানিয়েছে।তোমরা কি আমার সম্মানে আমার সাথীকে অব্যাহতি দিবে? এ কথাটি তিনি দুবার বললেন। অতঃপর আবূ বকর (রা:)-কে আর কখনও কষ্ট দেয়া হয়নি (বুখারী হা/৩৬৬১ ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ছাহাবীদের ফযীলত’অধ্যায়, অনুচেছদ-৫)।
No comments: